প্রধান দুই জোটের প্রার্থী আওয়ামী লীগে দুই ভাই চায় পুনরুদ্ধার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ আসনে গত দু’দফায় এমপি হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মাঈদুল ইসলাম মুকুল।
১৯৭৯ সালেও তিনি বিএনপি থেকে এমপি ও মন্ত্রী হন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে তিনি এমপি এবং মন্ত্রী হন। ১৯৯১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন আমজাদ হোসেন তালুকদার।
১৯৯৬ সালে এমপি হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুজ মোজাম্মেল হোসেন লালু। ২০০১ সালে মাওলানা মতিয়ার রহমান লাঙল নিয়ে বিজয়ী হন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে বিজয়ী হন মাঈদুল ইসলাম মুকুল।
আগামী নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী। তবে বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে এলাকায় না আসাসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।
গত দু’দফায় আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি ছাড়তে নারাজ আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন পেতে স্থানীয় নেতারা আ’লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
আগামী নির্বাচনে মাঈদুল ইসলামের আপন ছোট ভাই ও জেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি তাসভীরুল ইসলামও মনোনয়ন প্রার্থী। উলিপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি মতি শিউলীসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা শাসক দলের মনোনয়ন প্রার্থী। তবে কুড়িগ্রাম-৩ এলাকার অধিবাসীরা দুই ভাইয়ের লড়াই দেখার অপেক্ষায়।
পর্যবেক্ষক মহল বলছে, আলাদা নির্বাচন হলে লড়াই হবে ত্রিমুখী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপি মাঈদুল ইসলামের পথের কাঁটা এখন সনিক প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. আক্কাস আলী। মনোনয়নের আশায় জাপার কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু তাহেরও মাঠে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান এমপি এলাকায় কম আসেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যায় এলাকায় না আসায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। টিআর-কাবিখাসহ নিয়োগ নিয়েও বিস্তর অভিযোগ। এমপির অনুপস্থিতিতে তার ভাই শফিকুল হক দারাই এলাকার হর্তাকর্তা।
আগামী নির্বাচন ও অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী মাঈদুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘২০০৮ সালে ১ লাখ ৮৯ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হই। আমাকে এলাকার সবাই চেনেন-ভালোবাসেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যতটুকু কাজ করা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি করেছি। আশা করি সেই বিবেচনায় মানুষ আমাকে ফের ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে। দলের সিনিয়র হিসেবে আশাবাদী, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। আর জোটগত ভাবে নির্বাচন হলে বিজয় নিশ্চিত। দলের সাংগঠনিক অবস্থাও মোটামুটি ভালো। আমার শরীরটা ভালো নেই তাই এলাকায় খুব একটা যেতে পারছি না। সুস্থ হলে এলাকায় গণসংযোগে নামব।
তিনি বলেন কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বললেও তা শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া কিছুই নয়। এলাকার মানুষ জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাই এখানে জাতীয় পার্টির জয় সুনিশ্চিত।
সাবেক এমপি গোলাম হাবীব দুলাল জাতীয় পার্টি ছেড়ে ‘ট্রুথ পার্টি’ গঠন করে নির্বাচনের পরিকল্পনা পাকা করেছেন। গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে হতাশ হয়ে তিনি দল ছাড়েন। এর আগে চিলমারীর অধিবাসী হাবীব দুলাল কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি ছিলেন। পরে চিলমারীকে কুড়িগ্রাম-৩ আসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রু–থ পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হলেও তিনি নিবন্ধন নিয়েই নির্বাচন করতে আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত সেটা না হলে তিনি যে কোনো ফর্মে মাঠে থাকবেন। এরই মধ্যে তিনি প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাবেক এ প্রধান বনরক্ষক এমপি থাকা অবস্থায় মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছাড়াও ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এলাকায় তার নিজস্ব ভোট ব্যাংকও রয়েছে। কথা হয় গোলাম হাবীব দুলালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নীতি ও আদর্শের সঙ্গে একমত না হওয়ায় দল ত্যাগ করেছি। নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করছি। ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।’ সৌদি প্রবাসী আবু তাহের রাজনীতির মাঠে মাঈদুল ইসলামকে চ্যালেঞ্জ জানালেও দলের মনোনয়ন পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রার্থী হিসেবে উলিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মতি শিউলির অবস্থান বেশ শক্ত। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী (বীর বিক্রম), অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এমএ মতিন, সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন তালুকদার।
২০০৮ সালে প্রয়াত অধ্যক্ষ নাসিমা বানু ও ২০১৪ সালে মতি শিউলি দলের মনোনয়ন পেলেও মহাজোটের কারণে তাদেরকে আসন ছেড়ে দিতে হয়। এবারও মতি শিউলী মনোনয়নের জন্য লবিং করছেন। পাশাপাশি মাঠ দখলে রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন।
তাছাড়া গত কয়েক বছরে দলীয় কোন্দলের কারণে নেতাকর্মীদের মাঝে বিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কোন্দলে মাঝে-মধ্যেই সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এমনকি জাতীয় শোক দিবসেও ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষ ঘটেছে। বহিষ্কৃত হয়েছেন কয়েকজন। তারপরও নেতৃত্ব মতি শিউলির কব্জায়।
জানতে চাইলে মতি শিউলি বলেন, ‘আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। তৃণমূল থেকে উঠে এসে আমি এখন উলিপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি। একমাত্র আমিই নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। নিরন্তরভাবে মাঠে পড়ে থেকে মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে কাজ করছি। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা করছি। প্রচার করছি সরকারের উন্নয়ন ও ভালো কাজের। তাই আশা করি মনোনয়ন পাব।’
দলের কোন্দল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। মনোনয়ন পেলে সবাই দলের প্রার্র্থীর পক্ষেই একাট্টা হয়ে কাজ করবেন।’ তিনি জানান, বারবার জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়ার কারণে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। সরকারে থেকেও বিরোধী দলের মতো মনে হয়। তাই নেত্রীর কাছে দলের পক্ষ থেকে আসনটি দাবি করা হবে।
চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকারও (বীর বিক্রম) এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে তিনি নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। এ প্রসঙ্গে শওকত আলী সরকার বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় আমার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলাম। ব্যাপক উন্নয়নের অংশীদার আমি। তাই দলীয় মনোনয়ন পেলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত।’
উলিপুরের রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী আওয়ামী লীগ নেত্রী অধ্যক্ষ নাসিমা বানু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তার স্বামী অধ্যাপক এমএ মতিন একটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবার দলের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। এমএ মতিন বলেন, ‘মাঈদুল ইসলাম উলিপুরের উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। তাকে অপসারণে উলিপুরবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের হক নষ্ট করেছেন। দাম্ভিকতা দেখিয়ে জনগণকে দাবিয়ে রেখে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। তাই সুযোগ পেলে এ অসৎ ও অথর্ব নেতৃত্বকে হটিয়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।’
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে জেলা বিএনপির সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য তাসভীরুল ইসলাম ছাড়াও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল খালেক মনোনয়ন চাইবেন। তবে তাসভীরুল ইসলামের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। উলিপুর উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি।
মাঈদুল ইসলাম মনোনয়ন পেলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কতটা আন্তরিক হয়ে কাজ করবেন- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে তাসভীরুল ইসলাম কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। গত বন্যায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে তাসভীরুল ইসলাম সবার দৃষ্টি কাড়েন। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিল্পপতি তাসভীরুল ইসলাম এবং মাঈদুল ইসলাম মুকুল যে দল থেকেই প্রার্থী হন না কেন ভোটের রাজনীতিতে তারা দু’জনই ফ্যাক্টর। তাদের রয়েছে পারিবারিক ভোট ব্যাংক।
রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন ডা. আক্কাসের জনপ্রিয়তা থাকলেও কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন তা নিয়ে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকেন সব সময়। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনের কথা শোনা গিয়েছিল। শাসক দলের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার কথা শোনা যায়। সম্প্রতি তিনি বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে এলাকাবাসীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। বিত্তবান এ শিল্পপতি নির্বাচনকে ঘিরে সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর